একাত্তরের জেমস বণ্ড
লিখেছেন: রাজেশ পাল
আয়ান ফ্লেমিঙ’এর ‘জেমস বন্ড’ বা কাজী আনোয়ার হোসেন এর ‘মাসুদ রানা’ মাতিয়ে রেখেছিলো আমাদের অনেকের শৈশব, কৈশোর আর তারুণ্যকে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়তাম তাদের দুঃসাহসিক অভিযানের কাহিনী। সেই উচ্ছাসেই আজ লিখবো একজন রিয়েল লাইফ জেমস বণ্ডের কথা। এই বীর বাঙালি বন্ড তার সর্বশ্রেষ্ঠ অপারেশনে অংশ নিয়েছিলো বাংলাদেশের বাঙালীর ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্রান্তিকাল ১৯৭১’এ।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকটার সময়। পাকিস্তানের দুর্গন্ধী গদিতে তখন পচা গন্ধ ছড়াচ্ছে ক্যালিগুলার মতোই উন্মাদ রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান। মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান আর লাগামহীন বিকৃত যৌন রুচিতে আসক্ত এক রীতিমতো বদ্ধ উন্মাদ। চারদিক থেকে যতো বেশী পরাজয়ের সংবাদ আসে, ততোই দিনদিন বেড়ে যেতে থাকে তার বিকৃতি। সেই চেনা একই সমস্যা, যেমনটা হয়েছিলো হিটলারের লেলিনগ্রাদের দ্বারপ্রান্তে মুখ থুবড়ে পড়ার পরে। কি অদ্ভুত মিল ইতিহাসের অধ্যায়গুলোতে।
ইয়াহিয়ার কার্যক্রমের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বিবরণ দিয়েছেন পুলিশ বিভাগের রাওয়ালপিন্ডির বিশেষ শাখার সুপার সি এইচ সরদার। তিনি লিখেছেন:
“প্রেসিডেন্ট ভবন ছিল তখন বেশ একটা জায়গা। নানা মানুষজন আসছে। প্রেসিডেন্ট নিজে মাতাল আর রমণীমোহন। দেহপসারিনী আর তাদের দালালেরা তো বটেই, সমাজে মর্যাদাবান অনেকেই দেদারসে আনাগোনা করছে সেখানে। আকলিম আখতার, মিসেস কে এন হোসেন ও লায়লা মোজাফ্ফর ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। বহু নিন্দিত কিন্তু আকর্ষণীয় নারীও আসতো; তারা প্রেসিডেন্ট হাউস জুড়ে নাচতো, গাইতো, পান করতো। প্রেসিডেন্ট হাউসকে ওখানকার নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ বাহিনী বলতো কঞ্জরখানা, আর সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর বলতো ডাঙ্গরখানা। একবার ইরানের শাহ পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় সফরে এলে গভর্নর হাউসে ওঠেন। প্রেসিডেন্টও তখন সেখানে। শাহের বাইরে যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু প্রেসিডেন্ট তখনো শয়নকক্ষ থেকে বেরোচ্ছেন না। প্রটোকল নিয়ে মারাত্মক সমস্যা দেখা দিলো। কিন্তু কারও সেখানে যাওয়ার উপায় নেই। প্রেসিডেন্টের এম এস জেনারেল ইসহাক আকলিম আখতারকে বললেন তিনি যেন প্রেসিডেন্টকে নিয়ে আসেন। আকলিম জেনারেলের মক্ষীরানী হিসেবে পরিচিতি ছিলেন—প্রেসিডেন্টের রানী, আদতে বেশ্যার দালাল। ঘরে গিয়ে দেশের সবচেয়ে খ্যাতিমান গায়িকার সঙ্গে প্রেসিডেন্টকে তিনি যে অবস্থায় দেখেন, তাতে তারই আক্কেল গুড়ুম। প্রেসিডেন্টকে তিনি নিজে কাপড় পরিয়ে নিচে নিয়ে আসেন। ফুর্তি করার জন্য ইয়াহিয়ার বহু বান্ধবী ছিল। এক সন্ধ্যায় তিনি চলে গেলেন মিসেস কে এন হোসেনের বাড়িতে, যাঁকে সবাই ‘কালো সুন্দরী’ বলে জানত…সবার অগোচরে প্রেসিডেন্ট সেখানে তিন দিন তিন রাত কাটিয়ে দেন। চতুর্থ দিন মিসেস হোসেনকে রাষ্ট্রীয় অতিথিশালায় নিয়ে তিনি তাকে অভ্যন্তরীণ সজ্জাকরের স্থায়ী চাকরি দিয়ে দেন। তাঁর স্বামীকে সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত করা হয়। প্রেসিডেন্ট কেন তিন দিন তাঁর বাড়িতে ছিলেন, এ নিয়ে পরে প্রশ্ন করা হলে মিসেস হোসেন বলেন, প্রেসিডেন্টকে তিনি বাংলা গান শিখিয়েছেন।”
মদ্যপ আর লম্পট শিরোমণি এই পাক জেনারেলের নিয়মিত মন্ত্রীসভার বাইরেও ছিলো একটি ছায়া মন্ত্রীসভা। কানাঘূষা ছিলো যে উনার রাষ্ট্র পরিচালনার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোর বেশীরভাগই আসতো এই ছায়া মন্ত্রীসভা থেকে। বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে, এই ছায়া ক্যাবিনেটের সদস্য ছিলেন প্রেসিডেন্টের হাই প্রোফাইল বান্ধবীরা। এদের মধ্য জেনারেল রাণী , পাকিস্তানের কোকিলকন্ঠী গায়িকা নূরজাহান সহ প্রায় ১৪/১৫ জন অত্যন্ত হাই প্রোফাইল মহিলা যারা প্রত্যেকেই ছিলেন পাকিস্তানের পর্দার আড়ালের রাজনীতির প্রকৃত নিয়ন্তা , ভাগ্যবিধাতা। এরা নিজেরা ছিলেন যেমনি ইয়াহিয়ার রক্ষিতা, তেমনি ইয়াহিয়া খানের মনোরঞ্জনের জন্য নিত্যনতুন শয্যাসঙ্গিনীর অনুসন্ধান করাও ছিলো তাদের কাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ইয়াহিয়ার বিকৃত যৌনলালসার সূযোগ নিয়ে এরাই অনেকেই নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়েছিলো ভালোভাবেই। শুধু এরা নন, অনেক উচ্চপদস্থ পাক সামরিক, বেসামরিক অফিসাররাও নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করতে নিজেদের স্ত্রী কন্যাদের পৌছে দিতেন প্রেসিডেনন্সিয়াল পার্টিগুলোতে। এর বাইরেও কোন সুন্দরী অভিনেত্রী, টিভি উপস্থাপিকা বা গণিকার সন্ধান পেলেই শিকারী বেড়ালেই মতোই লাফিয়ে উঠতো জেনারেল সাহেবের মন। একবার বেশ মজার একটি ঘটনাও ঘটেছিলো। “ব্ল্যাক বিউটি” নামের জেনারেলের এক রক্ষিতা একই সাথে জেনারেল আর তার গুণধর পুত্রের মাঝে সমানতালে ভালোবাসা বিলোতেন। আর সেই সাথে সমানে চালিয়ে যেতেন নিজের ধান্ধা। একদিন ভুল করে বাপ-বেটাকে একই সাথে শিডিউল দিয়ে ফেলেন তিনি। ম্যাডামের ঘরের গেইটেই দেখা হয়ে যায় বাপ-বেটার। আর যায় কোথা। রীতিমতো তেলেবেগুণে জ্বলে উঠলেন ইয়াহিয়া। গুণধর পুত্রটিও কম যাননা। প্রচণ্ড উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের এক পর্যায়ে জেনারেল সাহেব কোমড় থেকে রিভলবার টেনে বের করলেন পুত্রকে গুলি করে মারার জন্য। ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার শাস্তি দিতে বদ্ধপরিকর তিনি।সৌভাগ্যক্রমে তার সামরিক সচিব জেনারেল পীরজাদা হাত থেকে টেনে রিভলবারটি সরিয়ে নেয়ায় সে যাত্রা ছেলের প্রাণ বেচে যায়। তবে এটা নিয়ে পরে জল অনেকদূর গড়িয়েছিলো।
এই মহিলাদের সাহায্যে পাকিস্তানের অনেক ব্যবসায়ীও অনেক লাভবান হয়েছেন সেসময়। বিভিন্ন সরকারী কন্ট্রাক্ট হাসিল করতে এরা ছিলেন একেবারে অব্যর্থ তীরন্দাজ। এদের টার্গেট কখনোই ব্যর্থ হতোনা।ছলে বলে কলে কৌশলে ইয়াহিয়ার কাছ থেকে কাজ তারা ঠিকই আদায় করে ছাড়তেন। এই মহিলাদের গড় বয়স ছিলো ৩৫ থেকে ৫৫ বছরের মধ্যে।এ ধরণের মহিলাদেরকেই ইয়াহিয়া পছন্দ করতেন। ত্রিশের নীচের মহিলাদের প্রতি তার এক ধরণের এলার্জি ছিলো।
এদিকে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধের ভয়াবহ আগুন জ্বলছে। একের পর এক শহর আর ক্যান্টনমেন্টের পতনে রীতিমতো দিশেহারা হয়ে পড়েছে পাকবাহিনী। প্রয়োজনীয় সাপ্লাইয়ের অভাবে পলে পলে ক্ষণে ক্ষণে দূর্বল থেকে দূর্বলতর হচ্ছে তারা। তাকিয়ে আছে কখন এগিয়ে আসবে চীনা বা মার্কিন সৈন্য তাদের নিশ্চিত পরাজয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে। যার প্রতিশ্রুতি যুদ্ধের শুরু থেকেই পেয়ে আসছিলো তারা। কিন্তু আজো যে সংবাদ নেই কোনো। অবধারিত পরাজয়ের মুখোমুখি হয়ে আরো বেশী হিংস্র হয়ে উঠছিলো তারা। প্রতিদিন বেড়ে চলছিলো খুন, ধর্ষণ আর নির্যাতনের মাত্রা, আর সেইব সাথে চেস্টা চলছিলো নিজেদের নির্যাতনের চিহ্নগুলো মুছে ফেলার। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ৯ নং গর্ত নামের বিশাল এক গর্ত খুড়েছিলো তারা। প্রতিদিন শয়ে শয়ে মুক্তিপাগল বাঙালীকে সেই গর্তের পাশে সারিবদ্ধভাবে দাড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করা হতো। পরে সেই লাশগুলো ফেলে দেয়া হতো সেই ৯ নং গর্তে। নির্যাতনের চিহ্ন মোছার প্ল্যানের অংশ হিসেবে রাতারাতি সেই গর্ত ভরাট করে ফুলের চারা লাগানো হলো। বিভিন্ন ক্যাম্পে বন্দী বীরাঙ্গনাদের শুরু হলো গণহারে খুন করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়ার প্রতিযোগীতা।
পশ্চিম পাকিস্তানে সামরিক জান্তার কড়া সেন্সরশীপের কারণে এই খবরগুলো খুব কমই পৌছাতো ওপারে। কিন্তু কিছু লোক শেষ পর্যন্ত জানলো বৈকি। এদের মধ্যেই একজন ছিলেন জাফর ইকবাল নামের করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ ছাত্র। জাফর ইকবালের পিতা ছিলেন উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মকর্তা। কর্মসূত্রে তার পোষ্টিঙ ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানেই। সম্পূর্ণ বৈরী পরিবেশে থেকেও পাকিস্তানবাদ মনে শেকড় গাড়তে পারেনি জাফরের পরিবারের। তরুণ জাফর তাই উদগ্রীব হয়ে ছিলেন বাংলার স্বাধীনতার পথ চেয়ে। পাকবাহিনীর মধ্যযুগীয় বর্বরতার সংবাদ শুনে ঘৃণায় রিরি করে ওঠে জাফরের মন। কিছু একটা করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন তিনি। সাথে জুটে যান আরো কয়েকজন বাঙালী ছেলে। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেন গুপ্তহত্যার। টার্গেট স্বয়ং ইয়াহিয়া খান। ডিক্টেটর অফ ইষ্ট পাকিস্তান। সূযোগ খুজতে থাকেন তারা। পেয়েও গেলেন। গোপন সূত্রে সংবাদ পেলেন এতো এতো নারী বান্ধবী থাকার পরেও মন ভরতোনা খান সাহেবের। পেশাদার হাইক্লাস কলগার্লদের ওখানেও গোপন যাতায়াত ছিলো তার। আর সেসময় বলতে গেলে দুজন অত্যন্ত বিশ্বস্ত দেহরক্ষী ছাড়া আর কেউ থাকেনা ইয়াহিয়ার সাথে। আর এদের মধ্যে রয়েছেন এক বাঙালী মহিলাও। এর চেয়ে বেটার সূযোগ আর কিইবা হতে পারে? মহিলার সাথে যোগাযোগ করলেন তারা। তাদেরকে অবাক করে দিয়ে এক কথাতেতেই রাজী হয়ে গেলেন তিনি। পেটের দায়ে দেহপসারিণী হলেও দেশপ্রেম ছিলো তার অন্তরে। ভেতরে ভেতরে জ্বলছিলেন তিনিও প্রতিশোধের আগুনে। যমুনা সকুল যেমন একদিন জ্বলে উঠেছিলেন রাসবিহারীর ডাকে।
পরিকল্পনা কষা হলো সুচারুভাবেই। আর সেই মতেই প্রেসিডেন্টের কাছে সংবাদ পাঠালেন তিনি বিশেষ বৈঠকের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে। শুনেই লাফিয়ে উঠলেন লম্পট ইয়াহিয়া। এসব আমন্ত্রণ না করার প্রশ্নই যে আসেনা। সাথে সাথে রাজী হয়ে গেলেন তিনি। আর জাফররা নিলেন চূড়ান্ত প্রস্তুতি। ব্ল্যাক মার্কেট থেকে জোগাড় করা রিভলবারগুলোতে বুলেট ঢুকিয়ে লোড করে নিলেন মরণ আঘাত হানার লক্ষ্যে।
নির্দিষ্ট দিনে মহিলার বাসার ঠিক উলটো দিকের বারান্দায় পজিশন নিলেন তারা। হঠাৎ কানে এলো নীচে মোটরগাড়ীর শব্দ। ব্যাপারটা কি? এখনো যে এক ঘন্টা বাকি। বেটা কি তবে তর সইতে না পেরে আগেই এসে পড়লো। আজরাইলের কাছে যাওয়ার সময় তবে একটু এগিয়েই এসেছে। আলো আধারিতে দেখা গেলো হ্যাট কোট পড়া একজন লোক ঊঠে আসছে সিড়ি বেয়ে। লোকটি এগিয়ে গেলো মহিলার দরজার দিকে।তারপর দিলো দরজায় টোকা। এ নিশ্চয়ই ইয়াহিয়া। আর অপেক্ষা করলেননা জাফররা। বেরিয়ে এলেন আড়াল ছেড়ে। সমস্বরে বেরিয়ে এলো “জয় বাংলা” শ্লোগান আর গর্জে উঠলো সবকটি রিভলবার নির্ভুল নিশানায়। ঘুরপাক খেয়ে শরীরটা উলটে পড়লো ব্যালকানিতে। পিস্তল হাতেই ছুটে গেলেন জাফররা। ছুটে এলেন মহিলাটিও। কিন্তু একি!!!!! এতো ইয়াহিয়া নয়। এতো মহিলার আরেক খদ্দের, পেশায় ব্যবসায়ী। একেই ইয়াহিয়া মনে করে গুলি ছুড়েছেন তারা। সামান্য উত্তেজনার বশে করে ফেলা ভুলের কারণে সেদিন একটুর জন্য বেচে যান ইয়াহিয়া খান।
জাফর ইকবাল আর তার সঙ্গীরা পালানোর চেষ্টা করেন। অন্যরা পারলেও পরদিনই ধরা পড়ে যান তিনি আর মহিলাটি। সেনা হেফাজতে নির্মম নির্যাতনের পরেও তাদের সঙ্গীদের নাম প্রকাশ করেননি তারা। পরে তাদের পাঠানো হয় জেলে। তাদের শেষ সংবাদ পাওয়া যায় ১৯৭৪ সালে। তখনো পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী তারা। জাফর ইকবাল আর তার সাথীরা কোথায় আছেন, কেমন আছেন, আদৌ বেচে আছেন কিনা কিছুই জানা নেই আমাদের।
শুধু সেদিনের এই রিয়েল লাইফ জেমস বণ্ডদের প্রতি স্যালুট জানিয়ে আমার এই লেখাটি তাদের উদ্দেশ্যেই নিবেদন করলাম।
আমরা তোমাদের ভুলবোনা……
আমরা তোমাদের ভুলবোনা……
Comments
Post a Comment