পীথাগোরাসের গণিত
পীথাগোরাস সম্ভবতঃ সর্বকালের হাতেগোনা সবচেয়ে খ্যাতিমান গণিতবিদদের একজন। তাঁকে অনেক সময় ইতিহাসের প্রথম ‘প্রকৃত’ গণিতবিদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। পীথাগোরাসের উপপাদ্য গণিতের সবচেয়ে বহুল আলোচিত এবং সবচেয়ে বেশি ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে প্রমানীত উপপাদ্য। আমরা গণিতের সৌন্দর্য বইটিতে এই উপপাদ্যটির বেশকিছু খুব সহজ প্রমাণ দেখেছিলাম।
তবে গণিতবিদ হিসেবে পীথাগোরাসের যতোই নামডাক থাকুক না কেন তিনি সমালোচনা ও বিতর্কের উর্দ্ধে ছিলেন না। সবচেয়ে অদ্ভুত ও মজার বিষয়টি হলো পীথাগোরাসের উপপাদ্যটি পীথাগোরাস আবিষ্কার করেন নি বরং একটি সমকোনী ত্রিভুজের তিনটি বাহুর উপর অঙ্কিত বর্গক্ষেত্রের সমষ্টির বিষয়টি পীথাগোরাসের জন্মেরও কয়েক শতক আগে থেকেই বিভিন্ন সভ্যতায় জানা-শোনা ছিলো! দুর্ভাগ্যের বিষয় পীথাগোরাসের নিজের লেখা কোনো কিছুই বর্তমানে অবশিষ্ট নেই বরং পীথাগোরাসের কাজ সম্বন্ধে আমাদের জানতে হয় সমসাময়িক অন্যান্যদের লেখা থেকে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন ফিলোলস এবং সেই সাথে আরো কিছু পীথাগোরিয়ান। পীথাগোরাস বেশ প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন এবং তাঁর বিরাট অনুসারী দল ছিলো। এই অনুসারীদেরই বলা হয় পীথাগোরিয়ান।
পীথাগোরাস আনুমানিক ৫৩০ খ্রীষ্টপূর্বে দক্ষিন ইতালির ক্রোটন নামক স্থানে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এটি যতটা না জ্ঞানার্জন ও গণিতচর্চার জন্য তারচেয়ে বেশী ছিলো আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় চর্চার পীঠস্থান। পীথাগোরাস গণিতকে ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতায় পরিণত করেছিলেন। পীথাগোরাস শুধুই একজন গণিতবিদ ছিলেন না একই সাথে তিনি ছিলেন একজন্য আধ্যাত্মিক নেতা ও দার্শনিক। সেই আধ্যাত্মিকতা চর্চার ক্ষেত্রে বেশ কিছু রহস্যাবর্তিত কঠোর অনুসঙ্গ তিনি বেছে নিয়েছিলেন। যেমন, তিনি ছিলেন একজন কট্টর নিরামিষাশী। তিনি বিপুল পরিমান ভক্তকুল নিয়ে দলবদ্ধভাবে বাস করতেন যাদের মধ্যে কঠোর নিয়মকানুন তিনি আরোপ করে দিয়েছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে কখনো সূর্যের দিকে ফিরে মুত্রত্যাগ না করা, সোনার অলঙ্কার পরিহিত কোনো নারীকে বিয়ে না করা, কোনো গাধাকে ডিঙ্গিয়ে কোনো রাস্তা অতিক্রম না করা, মটর জাতীয় খাবার না খাওয়া এমনকি স্পর্শও না করা।
তাঁর বিদ্যালয়ে তাঁর অনুসারীরা দুই ভাগে বিভক্ত ছিলো। একদলের নাম ছিলো “mathematikoi” বা শিক্ষার্থী, যাঁরা পীথাগোরাসের শুরু করা গণিত ও বিজ্ঞানচর্চা চালিয়ে যান, এমনকি পীথাগোরাসের নামে প্রচলিত অনেক কিছুই আসলে এদের মাধ্যমে উদ্ভাবিত বা আবিষ্কৃত হয়। আর অপর একদলের নাম ছিলো “akousmatikoi” (or “listeners”) বা শ্রোতা। এর মূলতঃ পিথাগোরাসের বিভিন্ন আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় রীতি-নীতি, আচারানুষ্ঠান এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। এই দুই দলের মধ্যে প্রায়শঃই নানাবিধ সংঘর্ষ লেগে থাকত। পীথাগোরিয়ানদের মধ্যে এধরনের সংঘর্ষ ও রহস্যময়তা থেকে জন্ম নেওয়া বিক্ষোভের ফলস্বরূপ ৪৬০ খ্রীষ্টপুর্বাব্দে তাঁর সবগুলো মিলনায়তন পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলা হয় এবং শুধুমাত্র ক্রোটনেই তাঁর ৫০ জন শিষ্যকে হত্যা করা হয়।
পীথাগোরাস গণিত এবং ধর্মকে একীভুত করে ফেলেছিলেন। তাঁর বিদ্যালয়ে শেখানো হতো “গণিতই সব” অথবা “গণিতই ঈশ্বর”। তিনি পূর্ণসংখ্যা খুব পছন্দ করতেন, সেগুলোকে বিশুদ্ধ মনে করতেন, এবং জগতের বিভিন্ন বিষয়াদিকে বিভিন্ন সংখ্যায় আরোপ করে তার পূজা করতেন। এভাবে সংখ্যা-পূজা নামক একটি বিষয়ের আবির্ভাব হয়। তিনি এক সংখ্যাটিকে বলতেন সকল সংখ্যার স্রষ্টা, দুইকে বলতেন মতামত, তিন হলো ঐকতান, চার ন্যায়পরায়নতা, পাঁচ বিবাহ, ছয় সৃষ্টি, সাত সাতটি গ্রহ অথবা ভ্রমনশীল তারা (রাতেরআকাশে সৌরজগতের গ্রহগুলোকে তারার মতোই দেখায় এবং সময়ের সাথে এগুলো অবস্থান পরিবর্তন করে। পীথাগোরাসের সময় সাতটি গ্রহ-উপগ্রহের বিষয়ে জানাশোনা ছিলো।) জোড় সংখ্যাগুলোকে তিনি নর এবং বিজোড় সংখ্যাগুলোকে নারীবাচক মনে করতেন।
তাঁর কাছে সবচেয়ে পবিত্র সংখ্যা ছিলো দশ। কেননা এই সংখ্যাটিকে এক, দুই, তিন, চার এই পুর্ণসংখ্যাগুলোর সমষ্টি হিসেবে পাওয়া যায় এবং এদেরকে একটি সমবাহু ত্রিভুজাকারে সাজানো যায় (নিচের চিত্র দ্রষ্টব্য)। দুই হাতের মোট দশটি আঙ্গুলের বাইরে আলাদাভাবে দশ সংখ্যাটির এই গণিতিক মাহাত্ব্য আবিষ্কার পীথাগোরীয় গণিতের একটি উল্লেখযোগ্য অবদান।
তবে পীথাগোরাস এবং তাঁর সময়ের অন্যান্য মুষ্টিমেয় কিছু গণিতবিদের সবচেয়ে বড় অবদান তাঁর গণিতে যুক্তি এবং উপপাদ্যের সমন্বয়ে তত্ত্ব তৈরি করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, পীথাগোরাসের আগে জ্যামিতি ছিলো কেবল কিছু অভিজ্ঞতালব্ধ পরিমাপের সমষ্টি। পীথাগোরাস এই অভিজ্ঞতালব্ধ পরিমাপগুলোকে সার্বিক তত্ত্বের আলোকে প্রতিষ্ঠা করেন। পীথাগোরাসের উপপাদ্যটিও তেমনই একটি তত্ত্ব। যদি্ও এই উপপাদ্যটি অনেক আগে থেকেই পরিমাপের কাজে প্রচলিত ছিলো কিন্তু তিনি সর্বপ্রথম একটি সমকোনী ত্রিভুজের তিনটি বাহুকে a2 + b2 = c2 সমীকরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেন। এবং এই সমীকরণের আলোকে তিনটি করে পুর্ণ সংখ্যা বিশিষ্ট পীথাগোরীয় ত্রয়ী (Pythagorean triplet) গুচ্ছের উদ্ভব ঘটে। যেমন: (৩, ৪, ৫), (৫, ১২, ১৩) ইত্যাদি। এই এয়ীগুলোর তিনটি সংখ্যার মধ্যে দুটির বর্গের সমষ্টি, তৃতীয়টির বর্গের সমষ্টির সমান হয়। যেমন: ৩২ + ৪২ = ৫২ বা ৫২ + ১২২ = ১৩২। পীথাগোরাসের উপপাদ্যটি পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন উপপাদ্যগুলোর একটি এবং এটি নিয়ে এত বেশী চর্চা হয়েছে যে গণিতের নানাবিধ শাখা ব্যবহার করে এর ৪০০টিরও বেশী বিভিন্ন ধরনের প্রমাণ প্রচলিত হয়েছে।
তবে ধর্ম থাকলে ধর্মীয় কুসংস্কারও থাকে। গণিত ছিলো পীথাগোরাসের ধর্ম এবং তিনি তাঁর গণিত ধর্মের সাথে সংঘর্ষিক কোনো কিছুর অনুমোদন দিতেন না। পীথাগোরাসের বিদ্যালয়ে অমূলদ সংখ্যা সম্বন্ধে কোনো ধরনের জ্ঞান ছিলো না। তিনি পুর্ণসংখ্যাকে খুবই পবিত্রজ্ঞান করতেন এবং তিনি ও তাঁর শিষ্যরা মনে করতেন যেকোনো সংখ্যাকে দুই পূর্ণ সংখ্যার অনুপাত রূপে প্রকাশ করা যায়। কিন্তু গোলমাল দেখা দিল √২ সংখ্যাটি নিয়ে। পীথাগোরীয় ত্রয়ীগুলো পুর্ণসংখ্যা দিয়ে শুরু হলেও পরবর্তীতে দেখা গেল ভগ্নাংশ দিয়েও এধরনের ত্রয়ী গঠন করা যায়। যেমন: (১, ১, √২)। যেহুতু পীথাগোরীয়ানরা বিশ্বাস করতেন যেকোনো সংখ্যাকেই দুটি পূর্ণসংখ্যার অনুপাতরূপে প্রকাশ করা যায় কাজেই √২ সংখ্যাটিও কে একইভাবে প্রকাশ করতে পারার কথা। কিন্তু পীথাগোরাসের একজন শিষ্য হিপ্পাসাস এর পূর্ণসংখ্যার রূপটি খুঁজতে গিয়ে দেখতে পেলেন কোনো ভাবেই √২ কে দুটি পুর্ণসংখ্যার অনুপাতরূপে প্রকাশ করা যাচ্ছে না এবং তিনি আবিষ্কার করলেন √২কে আসলে এভাবে প্রকাশ করা সম্ভবই নয়। এই ঘটনার মাধ্যমে অমূলদ সংখ্যা নামে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের একপ্রকার সংখ্যার অস্তিত্ব অনাবৃত হয়ে পড়ল। এই আবিষ্কার পীথাগোরাসের বিশুদ্ধ গণিতের সাম্রাজ্য ভীষণভাবে ঝাঁকিয়ে দিলো এবং সমগ্র “গণিত ধর্মের” বিশ্বাসের উপর আঘাত হানল। এই ব্লাসফেমী পীথাগোরাস মেনে নিতে পারলেন না এবং তাঁর নির্দেশে হিপ্পাসাসকে পানিতে ডুবিয়ে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হলো যেন বাইরের পৃথিবী এই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার সম্বন্ধে কোনো তথ্য পেতে না পারে। কিন্তু পূর্ণসংখ্যার অনুপাত রূপে প্রকাশের অযোগ্য সংখ্যার নতুন এই প্রকরণটি অর্থাৎ অমূলদ সংখ্যার আবিষ্কারের বিষয়টি সমগ্র গণিতের উন্নতি সাধনে বিরাট অবদান রেখেছিলো। অমূলদ সংখ্যার আবিষ্কারের মাধ্যমে গ্রীক জ্যামিতির প্রকৃত পুণর্জন্ম হলো যা একটি সমতলের রেখা এবং কোণ সম্পর্কিত বিভিন্ন গণনার নতুন দিগন্ত খুলে দিলো।
পীথাগোরাসের (কিংবা অন্ততঃ তাঁর কোনো শিষ্যের) জ্যামিতি বিষয়ক অন্যান্য অবদানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো “ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি দুই সমকোণ বা ১৮০ ডিগ্রি” এই উপপাদ্য আবিষ্কার। এটিকে পরবর্তীতে অন্যান্য বহুভুজের জন্যও বিবর্ধিত করা হয়েছিলো। এই উপপাদ্য থেকে সাধারণভাবে পাওয়া যায়, n বাহু বিশিষ্ট কোনো একটি বহুভুজের কোণসমূহের মোট সমষ্টি (২n-৪) সংখ্যক সমকোণ। পীথাগোরিয়ানরা এমনকি কোনো প্রদত্ত ক্ষেত্রফলের সমীকরণ থেকে চিত্র আঁকতে পারতেন এবং জ্যামিতিক বীজগণিতের মাধ্যমে সমীকরণের সমাধান নির্ণয় করতে জানতেন।
পীথাগোরিয়ানরা একই সাথে সংখ্যা তত্ত্বেরও সূচনা করেছিলেন। তাঁরা পারফেক্ট সংখ্যা (যেসব সংখ্যা তাদের গুননীয়কসমূহের সমষ্টির সমান, ২৮ এমন একটি সংখ্যা) আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁরা বর্গীয় সংখ্যাগুলোর বিভিন্ন বৈশিষ্ট খুঁজে বের করেছিলেন। যেমন: একটি ধনাত্মক পূর্ণ সংখ্যা n এর বর্গ হবে প্রথম n সংখ্যক ধনাত্মক বিজোড় সংখ্যার সমষ্টির সমান। অর্থাৎ, n২ = ১ + ৩ + ৫ + …… + n। উদাহরন হিসেবে বলা যায়, ৪২ = ১ + ৩ + ৫ + ৭ = ১৬। তাঁরা প্রথম একজোড়া ‘বন্ধুত্বপুর্ণ সংখ্যাও (যে সংখ্যাগুলোর একটির গুণনীয়কগুলোর যোগফল অপরটির গুণনীয়কগুলোর যোগফলের সমান)’ নির্ণয় করেছিলেন। এই সংখ্যাদুটি হচ্ছে ২২০ এবং ২৮৪।
পীথাগোরাসকে সঙ্গীতের সুরেলা নোটগুলোর মধ্যে পুর্ণসংখ্যক অনুপাত আবিষ্কারের জন্যও কৃতিত্ত্ব দেওয়া হয়। পশ্চিমা, উপমহাদেশীয়সহ পৃথিবীর প্রায় সকল সঙ্গীতের নোটগুলো সুনির্দিষ্ট কিছু কম্পাঙ্কের হয়ে থাকে। যেমন: একটি কম্পাঙ্গের দ্বিগুন কম্পাঙ্ক একটি অক্টেভ নির্দেশ করে। এভাবে সা, রে, গা, মা, পা, ধা, নি, সা ইত্যাদি নোটগুলোর প্রতিটির কম্পাঙ্কের মধ্যে সরল পূর্ণ সংখ্যক অনুপাত থাকে, এই বিষয়টি পীথাগোরাস দেখিয়েছিলেন। ১২ নোট বিশিষ্ট একটি ক্রোমাটিক স্কেলকে অনেক সময় পীথাগোরীয়ান টিউনিং বলা হয় কারণ এই স্কেলের নোটগুলোর মধ্যে ৩:২ অনুপাত (perfect fifth) বজায় থাকে যা পীথাগোরাসই প্রথম উল্লেখ করেন। এই আবিষ্কারে পীথাগোরাস এতোই উত্তেজিত বোধ করেন যে তিনি ধরে নেন যে এই সমগ্র মহাবিশ্বই সংখ্যার উপরে ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। গ্রহ-উপগ্রহগুলো সংখ্যার উপর ভিত্তি করেই ঘুর্ণায়মান থাকে এবং এদের মধ্যে সঙ্গীতের মতোই কোনো ঐকতান জড়িত।
Comments
Post a Comment